SEO Expert BD

কাজী নজরুল ইসলামের ছোট গল্প- ‘অতৃপ্ত কামনা’

কাজী নজরুল ইসলামের ছোট গল্প-

‘অতৃপ্ত কামনা’SEO

সাঁঝের আঁধারে পথ চলতে চলতে আমার মনে হল, এই দিনশেষে যে হতভাগার ঘরে একটি প্রিয় তরুণ মুখ তার ‘কালো চোখের করুণ কামনানিয়ে সন্ধ্যাদীপটি জ্বেলে পথের পানে চেয়ে থাকে না, তার মতো অভিশপ্ত বিড়ম্বিত জীবন আর নেই!

আমারই বেদনা-রাগে রঞ্জিত হয়ে গগনের পশ্চিম দুয়ারে জ্বালা সন্ধ্যা-তারা আমার মুখে তার অশ্রু-ভরা ছল-ছল চোখ নিয়ে চেয়ে ওই কথাটিতে সায় দিলে। ঝিল্লি-তান-মুখরিত মাঠের মৌন পথ বেয়ে যেতে যেতে শ্রান্ত চিন্তা কয়ে গেল, – ‘তোমায় ব্যথা বোঝে শুধু ওই এক সাঁঝের তারা!’

যদি কোনো ব্যথাতুর একটি পল্লি হতে আর একটি পল্লিতে যেতে এমনই সাঁঝে একা শূন্য মাঠের সরু রাস্তা ধরে চলতে থাকে – তার সামনে এক টুকরো টাটকা কাটা-কলজের মতো এই সন্ধ্যাতারাটি ফুটে ওঠে, তবে সেই বুঝবে কত বুক-ফাটা ব্যথা সে সময় তার মনে হয়ে তাকে নিপীড়িত করতে থাকে।

এই মলিন মাঠের শূন্য বুকে কিছু শোনা যাচ্ছে না, শুধু কোথায় সান্ধ্য নীড়ে বসে একটি ‘ধূলো-ফুরফুরি’ শিস দিয়ে দিয়ে বাউল গান গাইছে, আর তারই সূক্ষ্ম রেশ রেশমি সুতোর মতো উড়ে এসে আমার আনমনা-মনে ছোঁয়া দিচ্ছে! একটি দুটি করে আশমানের আঙিনায় তারা এসে জুটছে, আমার মনের মাঝেও তাই অনেক দিনের অনেক সুপ্ত কথার, অনেক লুপ্ত স্মৃতির একটির পর একটির উদয় হচ্ছে।

আমার এই একই কথা, একই ব্যথা যে কত দিক দিয়ে কত রকমে মনে পড়ছে, তার আর সংখ্যা নেই। তবু বারে বারে ও-কথাটি ও-ব্যথাটি জাগবেই! মন আমার এ বেদনার নিবিড় মাধুর্যকে আর এড়িয়ে যেতে পারলে না। সাপ যেমন মানিক ছেড়ে তার সেই মানিকটুকুর আলোর বাইরে যেতে পারে না, আমারও হয়েছে তাই। আমার এই বুকের মানিক বেদনাটুকুর অহেতুক অভিমানের মায়া এড়িয়ে যেতে পারলাম না! অনেক দূরে হাটের ফেরতা কোনো ব্যথিতা পল্লি-বধূ মেঠো সুরে মাঠের বিজন পথে গেয়ে যাচ্ছিল, –‘পরের জন্যে কাঁদ রে আমার মন, হায়, পর কি কখন হয় আপন?’

আমি মনে মনে বললাম – হয় রে অভাগি, আপন হয়; তবে অনেকে সেটা বুঝতে পারে না। বুকের ধনকে ছেড়ে গেলেই লোকে ভুল বুঝে বলে, –‘পর কি কখন হয় আপন?’ আর একজনও ঠিক এমনই ভুল করে আমায় ছেড়ে গেছে, সে বেদনা ভুলবার নয়!

পথের বিরহিণীর ওই প্রাণের গান আমায় মনে করিয়ে দিলে অমনি আর একজন অভিমানিনীর কথা। সেই দিল-মাতানো স্মৃতিটি মাঝিহারা ডিঙির মতো আমার হিয়ার যমুনায় বারে বারে ভেসে উঠছে!

তাতে-আমাতে পরিচয় তো শুধু ছেলেবেলা থেকে নয় – তারও অনেক আগে থেকে; সেই চির-পরিচয়ের দিন তারও মনে নেই, আমারও মনে নেই। … আমাদের পাড়াতেই তার বাড়ি।

তাকে আমার বিশেষ করে দরকার হত সেই সময়, যখন কাউকে, মারবার জন্যে আমার হাত দুটো ভয়ানক নিশ-পিশ করে উঠত। এ-মারারও আবার বিশেষত্ব ছিল; যখন মারবার কারণ থাকত, তখন তাকে মারতাম না, কিন্তু বিনা কারণে মারাটাই ছিল আমার খেপা-খেয়াল। আমার এ-পিটুনি খাওয়াটাকে সে পছন্দ করত কি না জানি নে, তবে দু-দিন না মারলে সে আমার কাছে এসে হেসে বলত, – ‘কই ভাই, এ দু-দিন যে আমায় মারনি?’

আমি কষ্ট পেয়ে বলতাম, – ‘না রে মোতি, তোকে আর মারব না!’ তার পর, সে সময় আমার হাতের সামনে যা-কিছু ভালো জিনিস থাকত, তাই তাকে দিয়ে যেন আমার প্রাণে গভীর তৃপ্তি আসত! মনে হত, এই নিয়ে সে হয়তো আমার আঘাতটাকে ভুলবে।

বই থেকে ছবি ছিঁড়ে তাকে দেওয়াই ছিল আমার সবচেয়ে মূল্যবান উপহার। এর জন্যে প্রায়ই পাঠশালায় সারা দিন কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। কিন্তু যখন দেখতাম যে, আমার দেওয়া ওই মহা উপহার সে পরম আগ্রহে আঁচলের আড়াল করে নিয়ে গিয়ে তার পুতুলের বিছানা পেতে দিয়েচে, কিংবা তার খেলাঘরের দেওয়ালে ভাত দিয়ে সেগুলো এঁটে দিয়েছে, তখন আমার পাঠশালার সব অপমান ভুলে যেতাম। কিন্তু তার ওই মেনি বিড়ালটাকে আমি দু-চোখে দেখতে পারতাম না, তাকে যে অত আদর করবে রাতদিন, এ যেন আমার সইত না। সে আমায় রাগিয়ে তুলবার জন্যে কোনো দিন আমার দেওয়া সবচেয়ে ভালো ছবিটা আঠা দিয়ে ওই মেনি বিড়ালছানাটার পিঠে এঁটে দিত, আমিও তখন থাপ্পড়ের চোটে তার দুলালি বিড়ালবাচ্চাটাকে ত্রিভুবন দেখিয়ে দিতাম।

তার দেখাদেখি আমিও সময় বুঝে যেদিন সে রেগে থাকত বা মুখখানা হাঁড়ি-পানা করে বসে থাকত, তখন জোর ধুমসুনি দিয়ে তাকে কাঁদিয়ে ছাড়তাম। তখন আমার আনন্দ দেখে কে! সে যত কাঁদত, আমি তত মুখ ভেঙিয়ে তাকে কাঁদিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসতাম। এক এক দিন তার পিঠের চামড়ার পাঁচটি আঙুলের কালো দাগ ফুটিয়ে তবে ছাড়তাম! আশ্চর্য হয়ে দেখতাম, ওই মার খাওয়ার পরেই সে বেশ শায়েস্তা হয়ে গেছে; আর, এক মিনিটে কেমন করে সব ভুলে গিয়ে জল ভরা চোখে মুখে প্রাণভরা হাসি এনে আমার আঙুলগুলো টেনে মুচড়িয়ে ফুটিয়ে দিতে দিতে বলছে, – ‘তোমার এই মারহাট্টা হাতের দুষ্টু আঙুলগুলোকে একেবারে ভেঙে নুলো করে দিতে হয়! তা হলে দেখি, তোমার ওই ঠুঁটো হাত দিয়ে কেমন করে আমায় মার!’ তার হাসি দেখে রেগে পিঠের উপর মস্ত একটা লাথি মেরে বলতাম, – ‘তাহলে এমনি করে তোর পিঠে ভাদুরে তাল ফেলাই!’

সে কাঁদতে কাঁদতে তার দাদাজিকে বলে দিত গিয়ে এবং তিনি যখন চেলা-কাঠ নিয়ে আমায় জোর তাড়া করতেন, তখন সে হেসে একেবারে লুটিয়ে পড়ত! রাগে তখন শরীর গশ-গশ করত। তাই আবার ফাঁকে পেলেই তাকে পিটিয়ে দোরস্ত করে দিতাম। কোনোদিন বা তার খেলা-ঘরের সব ভেঙে চুরে একাকার করে দিতাম, এই দিন সে সত্যি-সত্যি খেপে গিয়ে আমার পিঠে হয়তো মস্ত একটা লাঠির ঘা বসিয়ে দিন পনেরো ধরে লুকিয়ে থাকত, ভয়ে আর কিছুতেই আমার সামনে আসত না। সেই সময়টা আমার বড্ড দুঃখ হত। আ মলো, ও-লাঠির বাড়িতে আমার এ মোষ-চামড়ার কি কিছু হয়? আর লাগলই বা! তাই বলে কি বাঁদরি এমন করে লুকিয়ে থাকবে? তার পর যখন নানান রকমের দিব্যি করে কসম খেয়ে ফুসলিয়ে তাকে ডেকে আনতাম, তখন সে আমার লম্বা চুলগুলো নিয়ে নানান রকমের বাঁকা-সোজা সিঁথি কেটে দিতে দিতে বলত ‘দেখো ভাই, আর আমি কখ্‌খনো তোমায় মারব না! যদি মারি তো আমার হাতে যেন কুঠ হয়, পোকা হয়!’

তারপরে হঠাৎ বলে উঠত, –‘আচ্ছা ভাই, তুমি যদি আমার মতোন বেটি ছেলে হতে, তাহলে বেশ হত, – নয়? – দাও না ভাই, তোমার চুলগুলো আমার ফিতে দিয়ে বেঁধে দিই।’ কোনোদিন সে সত্যি-সত্যিই কখনো কথা কইতে কইতে দুষ্টুমি করে চুলে এমন বিউনি গেঁথে দিত যে, তা ছাড়াতে আমার একটি ঘন্টা সময় লাগত।… তার পর কী হল? … এই শূন্য মাঠের খানিকটা রাস্তা পেরিয়েই আমার মনের শাশ্বত শ্রোতা জিজ্ঞেস করে উঠল, – হাঁ ভাই, তার পর কী হল?

আমার হিয়ার কথক কিছুক্ষণ এই নিঝুম সাঁঝের জমাট নিস্তব্ধতার মাঝে যেন তার কথা হারিয়ে ফেললে! হঠাৎ এই নীরবতাকে ব্যথিয়ে সে কয়ে উঠল, – ‘না – তোমায় আমি ভালোবাসি! সেদিন মিথ্যা কয়েছিলাম মোতি, মিথ্যা কয়েছিলাম!’ তার এই খাপছাড়া আক্ষেপ সাঁঝের বেলায় তোড়ি রাগিণী আলাপের মতো যেন বিষম বে-সুরো বাজল! – সে আবার স্থির হয়ে তার সুর-বাহারে পুরবির মূর্ছনা ফোটালে! চির-পিয়াসি আমার চিরন্তন তৃষিত আত্মা প্রাণ ভরে সে সুর-সুধা পান করতে লাগল!

এমনি করেই আমাদের দিন যাচ্ছিল। সে যখন এগারোর কাছাকাছি, তখন তাকে জোর করে অন্দর-মহলের আঁধার কোণে ঠেসে দেওয়া হল। সে কী ছটফটানি তখন তার আর আমার! মনে হল, এই বুঝি আমার জীবন-স্রোতের ঢেউ থেমে গেল! স্রোত যদি তার তরঙ্গ হারায়, তবে তার ব্যথা সে নিজেই বোঝে, বাঁধ-দেওয়া প্রশান্ত দিঘির জল তার সে বেদন বুঝবে না। মুক্তকে যখন বন্ধনে আনবার চেষ্টা করা হয়, তখনই তার তরঙ্গের কল্লোলে মধুর চল-চপলতার কলহ-বাণী ফুটে ওঠে! তাই এ-রকমে চলার পথে বাধা পেয়েই আমাদের সহজ ঢেউ বিদ্রোহী হয়ে মাথা তুলে সামনের সকল বাধাকে ডিঙিয়ে যেতে চাইলে। চির-চঞ্চলের প্রাণের ধারা এই চপল গতিকে থামাবে কে? পথের সাথি আমার হঠাৎ তার চলায় বাধা পেয়ে বক্র-কুটিল গতি নিয়ে তার সাথিকে খুঁজতে ছুটল। এতদিনে যেন সে তার প্রাণের ঢেউ-এর খবর পেলে!

সর্বক্ষণ কাছে পেয়ে যাকে সে পেতে চেষ্টা করেনি, সে দূরে সরে এই দূরত্বের ব্যথা, ছাড়াছাড়ির বেদনা তার বুকে প্রথম জেগে উঠতেই সে তাকে চিনল এবং বলে উঠল, – ‘যাকে চাই তাকে পেতেই হবে।’

বঞ্চিত স্নেহের হাহাকার, ছিন্ন বাসনার আকুল কামনা তার বুকে উদ্দাম উন্মাদনা জাগিয়ে দিয়ে গেল! তখন সে তার এই আকাঙ্ক্ষিত আশ্রয়কে নতুন পথে নতুন করে খুঁজতে লাগল। সে অন্তরে বুঝলে, এ সাথি না হলে আমি আমার গতি হারাব! এই রকম মুক্তি আর বন্ধনের যুঝাযুঝির মাঝে পড়ে সে কাহিল হয়ে উঠল! সমাজ বললে, – রাখ তোর এ মুক্তি – আমি এই দেওয়াল দিলাম!

সেই দেওয়ালে মাথা খুঁড়ে রক্ত-গঙ্গা বহালে, পাষাণের দেওয়াল – ভাঙতে পারলে না! এ-দিকে আমাকে কেউ রাখতে পারলে না! লোকের চলার উলটো পথে উজান বেয়ে চলাই হল আমার কাজ! অনেক মারামারি করেও যখন আমাকে স্কুলের খাঁচায় পুরতে পারলে না, তখন সবাই বললে, – এ ছেলের যদি লেখাপড়া হয় তবে সুগ্রীব-সহচর দগ্ধমুখ হনুবংশ কী দোষ করেছিল? তারাও হাল ছেড়ে দিলে, আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে দেখলাম এই বাধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে যত তাকে ভুলে রয়েছি, ততই যেন সে আমার একান্ত আপনার হয়ে আমার নিকটতম কাছে এসে আমার উপর তার সব নির্ভরতা সঁপে গেছে! –

যমুনা আসছিল সাগরের পানে, ওই সাগরও তার দিগন্ত-ছোঁয়া ঢেউ-এর আকুলতা লক্ষ বাহুর ব্যগ্রতা নিয়ে তার দিকে ছুটে যেতে চাইল! দুজনেই অধীর হয়ে পড়েছিল এই ভেবে – হায়! কবে কোন্ মোহানায় তাদের চুমোচুমি হবে, তারা এক হয়ে যাবে!…

আর আমাদের দেখা-শোনা হত না। কথা যা হত, তা কখনও সবাইকে লুকিয়ে ওই একটি চোরা-চাওয়ায়, নয়তো বাতায়নের ফাঁক দিয়ে দুটি তৃষিত অতৃপ্ত দৃষ্টির বিনিময়ে। ওই এক পলকের চাওয়াতেই যে আমাদের কত কথা শুধানো হয়ে যেত, কত ব্যথা-পুলক শিউরে উঠত, তা ঠিক বোঝানো যায় না!

আরও পাঁচ বছর পরের কথা!

একদিন শুনলাম তার বিয়ে হবে, মস্ত বড়ো জমিদারের ছেলে বি-এ পাস এক যুবকের সাথে। বিয়ে হবার পর সে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে, তার সাথে আমার এই চোখের চাওয়াটুকুও ফুরাবে, এই ব্যথাটুকুই বড়ো গভীর হয়ে মর্মে আমার দাগ কেটে বসে গেল! এ ব্যথার প্রগাঢ় বেদনা আমার বুকের ভিতর যেন পিষে পিষে দিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু যখন মেঘ-ছাড়া দীপ্ত মধ্যাহ্ন-সূর্যের মতো সহসা এই কথাটি আমার মনে উদয় হল যে, সে সুখী হবে, তখন যেন আমি আমার নতুন পথ দেখতে পেলাম। বললাম, – না, আমি জন্মে কারুর কাছে মাথা নত করিনি, আজও আমাকে জয়ী হতে হবে। আর দুঃখই বা কীসের? সে ধনী শিক্ষিত সুন্দর যুবকের অঙ্কলক্ষ্মী হবে, অভাগি মেয়েদের সুখী হবার জন্যে যা-কিছু চাওয়া যায় তার সব পাবে; কিন্তু হায়, তবু অবুঝ মন মানে না! মনে হয়, আমার মতোন এত ভালোবাসা তো সে পাবে না!

এই কথা ক-টি ভাবতে গিয়ে আমার বুক কান্নায় ভরে এল, – আমার যে বাইরের দীনতা তাই মনে পড়ে তখন আমাকে আমার অন্তরের সত্য-প্রেমের গৌরবের জোরে খাড়া হতে হল। এক অজানার উপর তীব্র অভিমানের আক্রোশে বললাম, নিজের সুখ বিলিয়ে দিয়ে এর প্রতিহিংসা নেব। ত্যাগ দিয়ে আমার দীনতাকে ভরে তুলব।

এত দ্বন্দ্বের মাঝে’ আমার প্রিয় সুখী হবে’ এই কথাটির গভীর তত্ত্ব প্রাণে আমার ক্রমেই কেটে কেটে বসতে লাগল, তার পর হঠাৎ এক সময় আমার বুকের সব ঝঞ্ঝা ঝড় বেদনা তরঙ্গ ধীর শান্ত স্তব্ধ হয়ে গেল! বিপুল পবিত্র সান্ত্বনায় তিক্ত মন আমার যেন সুধাসিক্ত হয়ে গেল! আঃ! কোথায় ছিলে এতদিন ওগো বেদনার আরাম আমার? এতদিন পরে নিশ্চিন্ততার কান্না কেঁদে শান্ত হলাম!

এ কোন্ অর্ফিয়াসের বাঁশির মায়া-তান, এমন করে আমার মনের দুরন্ত সিন্ধুকে ঘুম পাড়িয়ে গেল? … হায়, এতদিন বাঁশির এই জাদু-করা সুর কোথায় ছিল? –

সে দিন নিশীথ রাতে তার বাতায়নের পানে চেয়ে তাই গেয়েছিলাম, –‘আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে! এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর জীবন ভরে?’  

বাহঃ! এরই মধ্যেই দেখছি মাঠের সারা পথটা পেরিয়ে গাঁয়ের সীমা-রেখার কাছাকাছি এসে পড়েছি! দূর হতে ঘরে ঘরে মাটির আর কেরোসিনের যে ধোঁয়া-ভরা দীপের আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তাতেই আমার মন কেমন ওই প্রদীপ-জ্বালা ঘরের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে! মনে হচ্ছে, ওই দীপের পাশে ঘোমটা-পরা একটি ছোটো মুখ হয়তো তার দু-চোখ-ভরা আকুল প্রতীক্ষা নিয়ে পথের পানে চেয়ে আছে। দখিন হাওয়ায় গাছের একটি পাতা ঝরে পড়লে অমনি সে চমকে উঠছে, – ওই গো বুঝি তার প্রতীক্ষার ধন এল! তার বুকে এই রকম আশা-নিরাশার যে একটা নিবিড় আনন্দ ঘুরপাক খাচ্ছে, তারই নেশায় সে মাতাল!

আমার মনের সেই চিরকেলে অক্লান্ত বিরহী শ্রোতা তাড়া দিয়ে কয়ে উঠল, – ও সব পরে ভেবোখন, তার পর কী হল, বলো!…তখন গাঁয়ের মাথায় মায়ের নত-আঁখির স্নেহ-চাওয়ার মতো নিবিড় শান্তি নেমে এসেছে। করুণ বেদনার সাথে পবিত্র স্নিগ্ধতা মিশে আমার নয়ন-পল্লব সিক্ত করে আনলে। জল-ভরা চোখে আমার বাকি কথাটুকু মনে পড়ল।… তার বিয়ের দিন কতক আগের এক রাতে তাতে আমাতে প্রথম ও শেষ গোপন দেখা শোনা। সে বললে – ‘এ বিয়েতে কী হবে ভাই?’ আমি বললাম, ‘তুমি সুখী হবে।’

সে আমার সহজ কণ্ঠ শুনে তার বয়সের কথা, আমার বয়সের কথা – আমাদের ব্যবধানের কথা সব যেন ভুলে গেল। মাথার উপর আকাশ ভরা তারা মুখ টিপে হেসে উঠল। সে আবার তেমনই করে সেই ছেলেবেলার মতো আমার হাতের আঙুলগুলো ফুটিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘তা কী করে হবে? তোমাকে যে ছেড়ে যেতে হবে, তোমাকে যে আর দেখতে পাব না।’

এত দিনে তার এই নতুন রকমের আর্দ্র কণ্ঠের বাণী শুনলাম! তার টানা টানা চোখের ঘন দীর্ঘ পাতায় তারার ক্ষীণ আলো প্রতিফলিত হয়ে জানিয়ে দিল, সে কাঁদছে! আমি বললাম, – ‘তোমার কথা বুঝতে পেরেছি মোতি। কিন্তু তুমি যার কাছে যাবে, সে আমার চেয়েও তোমায় বেশি ভালোবাসবে; সেখানে গেলে আমাদের সব কথা ভুলে যাবে।’

অন্যে আমার প্রিয়কে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসবে, এই চিন্তাটাও যেন অসহ্য। তার স্বামী আমার চেয়ে ধনী হোক, সুন্দর হোক, শিক্ষিত হোক, কিন্তু আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসবে আমার ভালোবাসার মানুষটিকে, বড়ো অভিমানেই ওই কথাটা আমি বললাম, কিন্তু এ-কথাটা বলেই এবার আমারও যেন বিপুল কান্না কণ্ঠে ফেটে বেরিয়ে আসতে লাগল। সে কান্না রুধবার শক্তি নেই – শক্তি নেই। মূর্ছাতুরার মতো সে আমার হাতটা নিয়ে জোরে তার চোখের উপর চেপে ধরে আর্ত কণ্ঠে কয়ে উঠল, ‘না–না– না।’ কীসের এ ‘না’? আমি তীব্র কণ্ঠে কয়ে উঠলাম, – ‘ এ হতেই হবে মোতি, এ হতেই হবে। আমায় ছাড়তেই হবে।’

তখন এক অজানা দেবতার বিরুদ্ধে আমার মন অভিমানে আর তিক্ততায় ভরে উঠেছে। সে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে কয়ে উঠল, – ‘ওগো, চিরদিন তো আমায় মেরে এসেছ, এখনও কি তোমার মেরে সাধ মেটেনি? তবে মারো, আরও মারো – যত সাধ মারো।’

কত দিনের কত কথা কত ব্যথা আমার বুকের মাঝে ভরে উঠল! তার পরেই তীব্র তীক্ষ্ণ একটা অভিমানের কঠোরতা আমায় ক্রমেই শক্ত করে তুলতে লাগল। মন বললে – জয়ী হতেই হবে। আমি ক্রূর হাসি হেসে মোতিকে বললাম, ‘হুঁ! কিছুতেই মানবে না তো, তবে সত্যি কথাটাই বলি, – মোতি, তোমায় যে আমি ভালোবাসি না।’ কথাটা তার চেয়ে আমার বুকেই বেশি বাজল। সে তীরবিদ্ধা হরিণীর মতো চমকে উঠে বললে, – ‘কী?’ আমি বললাম, – ‘তোমায় এতদিন শুধু মিথ্যা দিয়ে প্রতারিত করে এসেছি মোতি, কোনোদিন সত্যিকার ভালোবাসিনি।’

আমার কণ্ঠ যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। আহত ফণিনীর মতো প্রদীপ্ত তেজে দাঁড়িয়ে সে গর্জন করে উঠল, – ‘যাও চলে যাও – তোমায় আমি চাইনে, সরে যাও। তুমি জল্লাদের চেয়েও নিষ্ঠুর, বে-দিল ! – যাও, সরে যাও।… তোমার পায়ে পড়ি চলে যাও, আর আমার ভালোবাসার অপমান কোরো না।’

দু-চোখ হাত দিয়ে টিপে কালবৈশাখীর উড়ো ঝঞ্ঝার মতো উন্মাদ বেগে সে ছুটে গেল। আমি টাল খেয়ে মাথা ঘুরে পড়তে পড়তে শুনতে পেলাম আর্ত-গভীর আর্তনাদের সঙ্গে বিয়ে-বাড়ির ছালনা-বাঁধা আঙিনায় কে দড়াম করে আছড়ে পড়ে গোঙিয়ে উঠল, – ‘মা–গো।’ ওই যে অনেক দূরের খেয়া-পারে ক্লান্ত মাঝির মুখে পরিশ্রান্ত ক্লান্ত মনের চিরন্তন কান্নাটি ফুটে উঠেছে, ও যেন আমারই মনের কথা, –মন-মাঝি তোর বইঠা নে রে, আমি আর বাইতে পারলাম না।’

ওগো আমার মনের মাঝি, আমারও এ-ক্লান্তি-ভরা জীবন-তরি আর যে বাইতে পারি নে ভাই! এখন আমায় কূল দাও, না হয় কোল দাও! –

আমার মনে বড়ো ব্যথা রয়ে গেল, সে হয়তো আমার ব্যথা বুঝলে না। যাকে ভালোবাসি, তাকে ব্যথা দিতে গিয়ে আমার নিজের বুক যে ব্যথার আঘাতে, বেদনার কাঁটায় কত ছিন্ন-ভিন্ন কীরকম ঝাঁঝরা হয়ে গেছে, হায়, তা যদি সে জানত – তা যদি মোতি বুঝতে পারত। ওঃ যাকে ভালোবাসি সেও যদি আমাকে ভুল বোঝে, তবে আমি বাঁচি কী নিয়ে? আমার এ রিক্ত জীবনের সার্থকতা কী? হায়, দুনিয়ায় এর মতো বড়ো বেদনা বুঝি আর নেই।

এই তো আমার গাঁয়ের আমবাগানে এসে ঢুকেছি। ওই তো আমার বন্ধ-করা আঁধার ঘর। চার পাশে দীপ-জ্বালানো কোলাহল-মুখরিত স্নেহনিকেতন, আর তারই মাঝে আমার বিজন আঁধার কুটির যেন একটা বিষমাখা অভিশাপ শেলের মতো জেগে রয়েছে। দিনের কাজ শেষ করে বিনা-কাজের সেবা হতে ফিরে ঘরে ঢুকবার সময় রোজ যে-কথাটি মনে হয়, বন্ধ দুয়ারের তালা খুলতে খুলতে আজও সেই কথাটিই আমার মনের চির ব্যথার বনে দাবানল জ্বালিয়ে যাচ্ছে।

একে একে সব ঘরেই প্রদীপ জ্বলবে, শুধু আমার একা ঘরেই আর কোনো দিন সন্ধ্যা-দীপ জ্বলবে না। সেই ম্লান দীপ-শিখাটির পাশে আমার আসার আশায় কোনো কালোচোখের করুণ-কামনা ব্যাকুল হয়ে জাগবে না!

বাইরে আমার ভাঙা দরজায় উতল হাওয়ার শুধু একরোখা বুকচাপড়ানি আর কারবালা-মাতম রণিয়ে উঠল, –

‘হায় গৃহহীন, হায় পথবাসী, হায় গতি-হারা!’

আমার হিয়ার চিতার চিরন্তনী ক্রন্দসীও সাথে সাথে কেঁদে উঠল, –

‘হায় গৃহহীন, হায় পথবাসী, হায় গতি-হারা!’

Key Elements of On-Page SEO 🔍

SEO Expert

In today’s digital era, having a strong online presence is the key 🔑 to success for any business. On-page SEO (Search Engine Optimization) is the secret sauce that makes your website visible 📈 and accessible to both search engines and users.

Read More…..

Recent Post

This is the heading

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.

Slide 1 Heading
Lorem ipsum dolor sit amet consectetur adipiscing elit dolor
Click Here
Slide 2 Heading
Lorem ipsum dolor sit amet consectetur adipiscing elit dolor
Click Here
Slide 3 Heading
Lorem ipsum dolor sit amet consectetur adipiscing elit dolor
Click Here
Previous slide
Next slide